Type Here to Get Search Results !

সাম্রাজ্যবাদের যুগ এবং রাজনৈতিক ঐক্য

the-age-of-imperialism-and-political-unification



    ষোড়শ মহাজনপদ :

    বৌদি-সাহিত্যে এই ১৬টি রাজ্য ষোড়শ মহাজনপদ নামে উল্লিখিত।

    এগুলি হল-অঙ্গ,মগধ,কাশী কোশল,অবন্তী,বয়স,বৃজি,মল্ল,চেদি,কুরু,পাঞ্চাল,মৎস্য,শূরসেন,অশ্মক,গান্ধার ও কম্বোজ।

    এই মহাজনপদগুলির কতকগুলি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও, অধিকাংশই ছিল রাজতান্ত্রিক।

    গুটিকয় রাজ্য বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে।ঐ রাজ্য গুলির মধ্যে অবন্তী,বয়স,কোশল ও মগধ ছিল অন্যতম।

    ধীরে ধীরে অন্য তিনটি শক্তিকে পরাজিত করে মগধ চূড়ান্ত ভাবে নিজ সির্বভৌম প্রাধান্য স্থাপনে সমর্থ হয়।



    হর্যঙ্ক বংশ :

    মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিম্বিসার মগধের সিংহাসনে বসেন।

    তাঁর উপাধি ছিল 'শ্রেণিক'।

    গিরিব্রজ ছিল তাঁর রাজধানী।

    বিম্বিসারের রাজত্বকালে মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ দু’জনেই মগধে নিজ নিজ ধর্মমত প্রচার করেন।

    বিম্বিসারের পর তাঁর পুত্র অজাতশত্রু মগধের সিংহাসনে বসেন।

    তিনি ছিলেন লিচ্ছবি রাজকন্যা চেল্লনার গর্ভজাত সন্তান।

    ‘কুনিক’ ছিল তাঁর উপাধি।

    অজাতশত্রুর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র উদয়ী মগধের সিংহাসনে বসেন।

    তাঁর রাজত্বকালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা পাটলিপুত্রে রাজধানী পরিবর্তন।



    শৈশুনাগ বংশ :

    পিতৃঘাত রাজা নাগরিকের অত্যাচা্রে প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে সুযোগ বুঝে তাঁরই মন্ত্রী শিশুনাগ রাজাকে হত্যা করে মগধের সিংহাসন অধিকার করেন।

    শিশুনাগ-প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ শৈশুনাগ বংশ নামে পরিচিত।

    শিশুনাগ প্রথমে গিরিব্রজে ও পরে বৈশালীতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।

    শিশুনাগের পুত্র কালাশোক পিতার মৃত্যুর পর মগধের সিংহাসনে বসেন।

    তাঁর রাজত্বকালে বৈশালী নগরীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ-সঙ্গীতির অধিবেশন বসেছিল।

    নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্ম নন্দ তাঁকে হত্যা করে মগধের সিংহাসন অধিকার করেন।



    নন্দ বংশ :

    মহাপদ্ম নন্দ ছিলেন শূদ্রবংশজাত।

    পুরাণে তাঁকে 'সর্বক্ষত্রান্তক' ও 'একরাট্' বলে অভিহিত করা হয়েছে।

    সবশেষে যিনি সিংহাসনে বসেন তাঁর নাম ধন নন্দ।



    মৌর্য সাম্রাজ্য :


    চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য :


    বুদ্ধদেব যে সময় তাঁর ধর্মমত প্রচার করেছিলেন সে সময় নেপালের অন্তর্গত তরাই অঞ্চল থেকে শুরু করে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার প্রায় মাঝামাঝি অঞ্চলকে বলা হত পিপ্পলীবন।

    এটি ছিল একটি প্রজাতন্ত্রী রাজ্য।

    এই ছোট্ট রাজ্যটির 'মোরীয়' ক্ষত্রিয়কুলের সন্তান চন্দ্রগুপ্তই হলেন মগধের মৌর্য-বংশের প্রতিষ্ঠাতা।

    কেউ বলেন 'মোরীয়’ শব্দ থেকেই 'মৌর্য' কথাটির উৎপত্তি।

    আবার কারও ধারণা চন্দ্রগুপ্তের মা 'মুরার' নাম থেকে 'মৌর্য’ কথাটির উৎপত্তি।

    এই মুরা নাকি কোন এক নন্দরাজার দাসী ছিলেন।

    চন্দ্রগুপ্ত শেষ পর্যন্ত বিন্ধ্য-পর্বতের অরন্যে এসে উপস্থিত হন।

    এখানেই নাকি তক্ষশিলা-নিবাসী এক তীক্ষ্ণধী ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়

    এই ব্রাহ্মণই ভারত ইতিহাসে বিখ্যাত কূটনীতি-বিশারদ চাণক্য বা কৌটিল্য নাম পরিচিত।ইনি বিষ্ণুগুপ্ত নামেও খ্যাত ছিলেন।

    মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই হলেন ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট।

    চাণক্য হন তাঁর মন্ত্র ও প্রধান পরামর্শদাতা।

    আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের পূর্বপ্রান্ত অর্থাৎ পশ্চিম-এশিয়ার গ্রীক রাজ্যগুলির অধিকার লাভ করেন তাঁর বিখ্যাত সেনাপতি সেলুকাস।

    সিরিয়ায় তিনি রাজধানী স্হাপন করেন।

    মিত্রতার চিহ্নস্বরূপ  সেলুকাস পাটলিপুত্রে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় মেগাস্থিনিস নামে এক গ্রীক দূত পাঠান।

    শেষ জীবনে চন্দ্রগুপ্ত সম্ভবতঃ জৈন ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

    এই দীর্ঘ সময় অবস্থানকালে মৌর্য সাম্রাজ্য ও তার শাসন পদ্ধতি সম্বন্ধে তিনি রে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তার ‘ইন্তিকা' নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন।



    কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে মৌর্য শাসনব্যবস্থা :

    চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী ও প্রধান পরামর্শদাতা চাণক্য 'কৌটিল্য' নাম নিয়ে 'অর্থশাস্ত্র' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।

    ‘স্থানিক’ নামে এক শ্রেণীর কর্মচারী জেলার দায়িত্ব বহন করতেন।

    'গ্রামিক' নামে এক শ্রেণীর কর্মচারী গ্রাম-বৃদ্ধদের পরামর্শে গ্রামের শাসনকার্য নির্বাহ করতেন।

    উৎপত্তি ফসলের সাধারণতঃ এক ষষ্ঠাংশ রাজস্ব আদায় করা হত। তবে বিশেষ বিশেষ সময় তা বাড়িয়ে ১/৪ অংশও করা হত।এই করকে বলা হত 'ভাগ';

    এছাড়া অন্যান্য নানা রকমের বিশেষ করও প্রচুর পরিমাণে আদায় করা হত, তাকে বলা হত 'বলী'।
    বিন্দুসার

    চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে মগধের সিংহাসনে বসেন।

    তিনি 'অমিত্রঘাত' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।



    অশোক :

    বিন্দুসার প্রায় ২৭ বছর রাজত্ব করেন।

    তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদের মধ্যে অশোক 'প্রিয়দশী' উপাধি নিয়ে খ্রীষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দে মগধের সিংহাসনে বসেন।

    সিংহলের 'মহাবংশ' নামে পালিগ্রন্থে লেখা আছে যে, অশোক তাঁর অন্যান্য ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে বসেন।এই কারণে তাঁকে ‘চন্তাশোক' বলা হত।

    বৌদ্ধ সন্ন্যাসী উপগুপ্তের কাছে তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন।

    সাম্রাজ্যের নানা স্থানে পাথরের স্তম্ভে ও পাহাড়ের গায়ে ধর্মের বাণীগুলি সাধারণের বোধগম্য প্রাকৃত ও ব্রাহ্মী ভাষার উৎকীর্ণ করে দেন।এগুলি ধর্মলিপি নামে পরিচিত।

    বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মতবিরোধ দূর করার জন্য রাজধানী পাটলিপুত্রে অশোক তৃতীয় বৌদ্ধ-সঙ্গীতি আহ্বান করেন।

    অশোক নিজের “দেবানমপিয় পিয়দসী” অর্থাৎ'দেবতাদের প্রিয় রাজা প্রিয়দর্শী' বলে পরিচয় দিতেন।

    অশোক ছিলেন যথার্থই 'মহামতি'-“মানবজাতির প্রথম ধর্মগুরু”।

    অশোকের মৃত্যুর (২৩২ খ্রীষ্ট-পূর্বব্দ)। অবশেষে ১৮৭ খ্রীষ্ট-পূর্বাব্দে শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে তাঁর ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্ক সিংহাসন অধিকার করলে মগধের এক গৌরবময় যুগের অবসান হয়। শুধু হয় শুঙ্ক বংশের শাসন।



    ভারতে বৈদেশিক আক্রমণ :

    উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে খাইবার,গোয়াল,বোলান প্রভৃতি গিরিদ্বারের মধ্য দিয়েই সম্ভব হত।

    বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করে পারস্যের আকেমেনীয় বংশীয় সম্রাট কাইরাস এই সময় ভারত-সীমান্তে এসে উপস্থিত হন।

    তবে গান্ধার রাজ্য জয় করার সময় কাইরাস আহত হন এবং তার ফলেই তাঁর মৃত্যু হয়।

    সম্রাটের একজন প্রতিনিধি দ্বারা প্রদেশটি শাসিত হত।পারফর্ম সম্রাটের এইরূপ বিভিন্ন প্রদেশের প্রতিনিধিরা 'ক্ষত্রপ' নামে পরিচিত ছিল।

    খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের মাঝামাঝি গ্রীক-বীর আলেকজান্ডার পারফর্ম সম্রাট তৃতীয় দরায়ুসকে পরাজিত করে পারফর্ম জয় করলে ভারতবর্ষে পারসিক শাসনের অবসান হয়।

    সময় গ্রীক দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত ম্যাসিডষ রাজ্যের রাজা আলেকজান্ডার পারস্য রাজধানী পার্সিপোলিস ভস্মীভূত করে ভারতের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হন।

    ঝিলামের পূর্ব তীরে,ঝিলাম ও চিনাব নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের পৌরবদের রাজা ছিলেন পুরু।

    খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে ঝিলাম নদীর পূর্বতীরে পুরু ও আলেকজান্ডারের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হয়। ঝিলাম বা বিতস্তা নদীকে গ্রীকরা হিদাস্পিস নামে উল্লেখ করেছে।তাই ঝিলামের এই যুদ্ধ 'হিদাস্পিসের যুদ্ধ' নামে খ্যাত।

    পরে ব্যাবিলন হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।এখানে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় ( জুন,খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দ )।

    ভারতীয় সভ্যতার গ্রীক প্রভাবের এক অনিন্দ্যসুন্দর নিদর্শন হল গান্ধার শিল্প।

    গ্রীক,রোমক ও ভারতীয় শিল্পরীতির সংমিশ্রণের ফলে এই শিল্পের জন্য।

    সোলুকাসের মেয়ে হেলেনের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিয়ে এদেশে সামাজিক সংকীর্ণতা দূরীকরণে সাহায্য করে।

    মেগাস্থিনিস-প্রণীত 'ইন্তিকা' ঐসব গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম।

    আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সেলুকাস পশ্চিম এশিয়ায় যে রাজ্য স্থাপন করেন খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে তার পতন শুরু হয়।

    ব্যাকট্রিয়াধিপতি ইউথিডেমসের পুত্র ডিমিট্রিয়স বা দিমিত্রি-র সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেন।

    ডিমিট্রিয়স এরপর মগল সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন।পুষ্যমিত্র শুঙ্গ তখন পাটলিপুত্রে্য সিংহাসনে।

    যুবরাজ অগ্নিমিত্র ডিমিট্রিয়সের এই আক্রমণ প্রতিহত করেন। মহাকবি কালিদাস 'মালবিকাগ্নিমিত্রম্' নাটক এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন।

    ডিমিট্রিয়স 'ভারতীয় গ্রীকগণের নরপতি' আখ্যা লাভ করেন। তাঁর রাজধানী ছিল শাকল (বর্তমান শিয়ালকোট )।

    ডিমিট্রিয়সের পরবর্তী ইন্দো-গ্রীক রাজগণের মধ্যে মিনান্দার বা মিলিন্দের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনিই ছিলেন উত্তর-পশ্চিম ভারতের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী গ্রীক রাজা।

    পারি ভাষায় লিখিত বিখ্যাত বৌদ্ধগ্রন্থ “মিলিন্দপঞহো “ (মিলিন্দ প্রশ্ন ) তারই সংকলন।

    উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রথম উল্লেখযোগ্য শক রাজা ছিলেন মোয়েস,মোয়া বা যোগ।

    'রাজাধিরাজ' ছিল তাঁর উপাধি।

    তাঁর পরবর্তী শাসক অয়েস (Azes) বা অয় পাঞ্জাবের কিছু অংশ অধিকার করেন।

    এইসব শক রাজাদের উপাধি ছিল 'ক্ষত্রপ’ বা ‘মহাক্ষত্রপ'।

    মথুরার শক ক্ষত্রপদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজুভুল। সম্ভবতঃ ইনিই পূর্ব পাঞ্জাব থেকে ব্যাকট্রিক গ্রীক শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন।

    ভৃগুকচ্ছের শক ক্ষত্রপদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ছিলেন মহাক্ষত্রপ নহপান।

    তিনি সম্ভবতঃ সাতবাহনরাজ গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর কাছে পরাজিত হন।

    শক ক্ষত্রপদের যে শাখার উজ্জয়িনীতে রাজত্ব করত মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামন ছিলেন সেখানকার শাসকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।

    জুনাগড় শিলালিপিতে তাঁর কীর্তিকাহিনী বর্ণিত আছে।

    অবশেষে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শক শক্তিকে নিশ্চিত করেন।

    ভারতীয় পহ্লবরাজগণের মধ্যে গন্তোফার্নিস ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।



    মৌর্য ও মৌর্যোত্তর যুগের সমাজ, অর্থনীতি ও শিল্প :

    মৌর্য মুখের মতই মৌর্যোত্তর যুগের অর্থনীতিও ছিল কৃষিভিত্তিক।

    ‘মহাবংশ’ ও ‘দীপবংশ' নামে দুটি সিংহলী গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, তদানীন্তন সিংহল-রাজের অনুরোধে অশোক সেখানে বেশ কয়েকবার দূত পাঠিয়েছিলেন।

    ঐসব স্তূপের চারিদিকে পাথরের রেলিং অর্থাৎ আবেষ্টনী দেওয়া রাস্তা করা হত।ও সমস্ত আবেষ্টনীর মধ্যে সব থেকে প্রাচীন হল ভারহুত স্তূপের পাথরের আবেষ্টনী।

    কুষাণরা ছিল মধ্য এশিয়ার 'ইউ চি' নামে একটি যাযাবর  জাতির শাখা।

    এই সময় ইউ চি-রা পাঁচটি স্বতন্ত্র শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়।কুষাণ হল তারই একটি শাখা।

    কুষাণ বংশের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজা হলেন কুজুল কদফিসেস্।

    তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বিম কদফিসেস্ কুষাণ সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। তিনি ভারতে প্রথম কুষাণ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।



    কুষাণ সাম্রাজ্য :


    কণিষ্ক :

    কুষাণ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন কণিষ্ক।

    ৭৮ খ্রীষ্টাব্দে কণিষ্ক সিংহাসনে আরোহণ করেন।

    এই সিংহাসনারোহণ কালকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি ঐ বৎসর থেকে 'শাকব্দ' নামে এক নতুন বর্ষ-গণনার প্রচলন করেন।

    পুরুষপুর (বর্তমান পেশোয়ার) ছিল কণিষ্কের রাজধানী।

    অনেকে কণিষ্ককে 'দ্বিতীয় অশোক' বলে অভিহিত করেন।সম্রাট অশোকের মত তিনি ও ছিলেন সকল ধর্মের প্রতি উদার।

    বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ ও অনৈক্য দূর করার জন্য কণিষ্ক চতুর্থ বৌদ্ধ-সঙ্গীতি আহ্বান করেন।

    'বুদ্ধচরিত' গ্রন্থ-প্রণেতা অশ্বঘোষ।

    পরবর্তীকালে জৈনরা যেমন 'শ্বেতাম্বর' ও 'দিগম্বর' নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়।

    বৌদ্ধরাও তেমনি 'মহাযান' ও 'হীনযান' নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

    সম্রাট কণিষ্ক সাহিত্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

    অশ্বঘোষ,নাগার্জুন,পার্শ্ব,বসুমিত্র,তর্ক প্রভৃতি বহু পণ্ডিত ও মনীষী তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেছেন।

    অশ্বঘোষ ছিলেন একাধারে কবি, দার্শনিক ও শাস্ত্রজ্ঞ। তাঁর 'বুদ্ধচরিত' একটি অপূর্ব সংস্কৃত কাব্য।

    এতে বুদ্ধদেবের জীবনী চিত্রীত হয়েছে।

    ‘বজ্রসূচী’ ব্রাহ্মণ্য বর্ণভেদের বিরুদ্ধে একটি অসাধারণ সৃষ্টি।

    মহাযান ধর্মমতের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ও কৃতি রসায়নবিদ নাগাজুন- রচিত 'মাধ্যমিক সূত্র' ও 'শতসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা' কুষাণ যুগে ভারতের বিশেষ উল্লেখযোগ্য সাহিত্য।

    বসুমিত্র রচিত বৌদ্ধদর্শন শাস্ত্র 'মহাবিভাষা' এবং আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের অদ্বিতীয় পণ্ডিত চরকের কালজয়ী সৃষ্টি 'চরক-সংহিতা' এযুগেই রচিত হয়।

    এ ছাড়াও, পতঞ্জলির 'মহাভাষ্য', গুণাঢ্যের 'বৃহৎকথা',নখগসেনের 'মিলিন্দ পঞহো' সুশ্রুতের 'সুশ্রুত সংহিতা'।

    কুষাণ রাজারবাগ এদেশে প্রথম স্বর্ণমুদ্রা চালু করেছিলেন।

    তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রাচীন ভারতে একটি প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র।

    এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হল গান্ধার শিল্প।



    সাতবাহন সাম্রাজ্য :

    পুরাণে এই রাজবংশ 'অন্ধ্রবংশ' নামে খ্যাত।

    সম্ভবতঃ এঁরা ব্রাহ্মণ ছিলেন।

    সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিমুক নামে এক ব্যক্তি।

    গোদাবরী নদীর তীরে 'প্রতিষ্ঠান' (বর্তমান পৈঠান) নগরী ছিল তাঁর রাজধানী।

    প্রথম সাতকর্ণীই ছিলেন সাতকাহন বংশের প্রথম শক্তিশালী রাজা।

    সম্ভবতঃ তিনি কলিঙ্গরাজ খারবেলা কর্তৃক পরাজিত হন।

    সাতবাহন বংশের ঐ লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধার করেন ঐ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী।

    সম্ভবতঃ ১০৬ খ্রীষ্টাব্দে যখন তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন বৈদেশিক ব্যাকট্রিয় গ্রীক,শক ও পহ্লব জাতির আক্রমণে সাতবাহন রাজ্য ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়।

    তাঁর মা বলশ্রীর লিপি থেকে আমরা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর বীরত্বকাহিনী সম্বন্ধে জানতে পারি।

    পরে সম্ভবতঃ তিনি উজ্জয়িনীর শক মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হন।

    গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র পুলুমায়ী সিংহাসনে বসেন।

    এই বংশের শেষ পরাক্রান্ত নরপতি ছিলেন যজ্ঞশ্রী সিতকর্ণী।

    সাতবাহন রাজ্য ছিল সম্ভবতঃ মাতৃতান্ত্রিক।

    কৃষ্ঞ বা বাসুদেবের পূজারী ছিলেন।

    সাতবাহন রাজ্যে সরকারি ভাষা ছিল প্রাকৃত।



    গুপ্ত  সাম্রাজ্য :

    শ্রীগুপ্ত ছিলেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা।

    সম্ভবতঃ ২৭৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন।

    গুপ্তবংশের প্রথম শক্তিশালী রাজা হলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত।

    তাঁর পিতা ঘটোৎকচ গুপ্ত ছিলেন শ্রীগুপ্তের পুত্র।

    প্রথম চন্দ্রগুপ্ত 'মহারাজাধিরাজ' উপাধি গ্রহণ করেন।

    তিনি ৩২০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর রাজ্যাভিষেকের বছর থেকে 'গুপ্তাব্দ' নামে একটি নতুন সন গণনার করেন।
    সমুদ্রগুপ্ত (৩৩৫-৩৮০ খ্রীঃ)

    প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পরে সম্ভবত ৩৩৫ খ্রীষ্টাব্দে সমুদ্রগুপ্ত পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

    সমুদ্রগুপ্তই ছিলেন গুপ্তবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি।

    সমুদ্রগুপ্তের 'পরাক্রমাঙ্ক' উপাধি গ্রহণ সার্থক হয়েছিল।

    সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ-রচিত একটি প্রশস্তি লিপিবদ্ধ আছে।‘এলাহাবাদ প্রশস্তি' নামে খ্যাত ঐ লিপিতে সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয় কাহিনী বর্ণিত আছে।

    ও প্রশস্তিতে সমুদ্রগুপ্তকে 'সর্বরাজোচ্ছেত্তা' বলে অভিহিত করা হয়েছে।

    ও সময় তিনি রুদ্রদেব,মতির,নাগদত্ত,চন্দ্রবর্মন,গণপতি নাই,নাগসেন,অচ্যুত,নন্দী ও বলবর্মন-এই ন'জন রাজাকে পরাজিত করে তাঁদের রাজ্য নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

    হরিষেণ সমুদ্রগুপ্তের এই রাজ্য বিজয় নীতিকে 'গ্রহণ পরিমোক্ষ' বলে বর্ণনা করেছেন।

    ভিনসেন্ট স্মিথ ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সঙ্গে তুলনা করে সমুদ্রগুপ্তকে 'ভারতের নেপোলিয়ন' বলে অভিহিত করেছেন।

    সংস্কৃত পণ্ডিত ও কবি হরিষেণ তাঁর প্রশাস্তিতে সমুদ্রগুপ্তকে 'কবিরাজ' অর্থাৎ কবিশ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন।

    সম্ভবতঃ ৩৮০ খ্রীষ্টাব্দে 'বিক্রমাদিত্য' উপাধি নিয়ে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পাটলিপুত্রের সিংহাসনে বসেন।

    তিনি 'শকারি' অর্থাৎ শকদের শত্রু নামে পরিচিত হন এবং উজ্জয়িনীতে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন।

    তাঁর রাজসভা ন'জন প্রতিভা বা 'নবরত্ন' দ্বারা অলংকৃত ছিল।

    এই 'নবরত্ন' ছিলেন-কালিদাস,ধন্বন্তরি,ক্ষপণক,শঙ্কু,বেতালভট্ট,ঘটকর্পর,অমরসিং,বরাহমিহির ও বরুচি।



    ফা - হিয়েন -এর বিবরণ :

    দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ভারতে আসেন।

    ফা-হিয়েন প্রায় ১৫ বছর এদেশে অবস্থান করেছিলেন।

    তাঁর ভ্রমণ-কাহিনী 'ফো-কুয়ো-কিং' থেকে সে সময়ের ভারতবর্ষ সম্বন্ধে অনেক কথা জানা যায়।

    ফা-হিয়েন গ্রীকদূত মেগাস্থিনিসের ৭০০ বছর পরে এসে।

    বঙ্গদেশের তাম্রলিপ্ত তখন একটি শ্রেষ্ঠ সামুদ্রিক বন্দর হিসাবে পরিচিত ছিল।



    প্রথম কুমারগুপ্ত(৪১৫-৪৫৫ খ্রীঃ) :

    দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম কুমারগুপ্ত ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

    তিনি 'মহেন্দ্রাদিত্য' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।



    স্কন্দগুপ্ত (৪৫৫-৪৬৭ খ্রীঃ) :

    প্রথম কুমারগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র স্কন্দগুপ্ত 'বিক্রমাদিত্য' উপাধি গ্রহণ করে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

    রমেশচন্দ্র মজুমদার স্কন্দগুপ্তকে 'ভারতবর্ষের রক্ষাকর্তা' বলে অভিহিত করেছেন।



    গুপ্ত যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি :

    গুপ্তযুগকে ভারত-ইতিহাস 'সুবর্ণ-যুগ' (Golden Age ) বলে অভিহিত করা হয়।

    এই যুগে সাহিত্যের প্রথম ভাষা ছিল সংস্কৃত।

    সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত নিজে সুপণ্ডিত ও সুসাহিত্যিক ছিলেন। তিনি 'কবিরাজ' অর্থাৎ শ্রেষ্ঠকবি উপাধি পান।

    তাঁর সভাকবি হরিষেণ-রচিত 'এলাহাবাদ প্রশস্তি' একটি সার্থক সৃষ্টি।

    সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের 'নবরত্ন সভা’-র শ্রেষ্ঠ রত্ন মহাকবি কালিদাস ছিলেন বিশ্বসাহিত্যের 'অভিজ্ঞান শকুন্তলাম্', মহাকাব্য 'রঘুবংশ' ও ‘কুমারসম্ভব' এবং গীতিকাব্য 'মেঘদূতম' সংস্কৃত সাহিত্যভাণ্ডারের রত্নবিশেষ। ‘ঋতুসংহার’,'মালবিকাগ্নিমিত্রম্' প্রভৃতি সৃষ্টি যে কোন যুগের,যে কোন দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টির সমকক্ষ বলে গণ্য হতে পারে।

    এই যুগেই 'মৃচ্ছকটিক' নাটকের রচয়িতা শূদ্রক 'মুদ্রারাক্ষস' নাটকের রচয়িতা বিশাখদত্ত।

    মনুর বিধানাবলীর সংকলনকার্য মনুসংহিতা এই যুগে রচিত হয়।

    • প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ গণিতশাস্ত্রবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানি আর্যভট্ট (জন্ম ৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ) এই যুগেরই সন্তান।

    দিল্লীর কুতবমিনারের নিকটে প্রাপ্ত আজ ও বিজ্ঞানের বিস্ময় 'চন্দ্ররাজ' নামাঙ্কিত লৌহস্তম্ভটি এই সময়েই তৈরি হয়।

    উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি জেলার দেওগড়ের পাথরের তৈরি দশ-অবতার মন্দির এবং কানপুর জেলার ভিটারগাঁও-এর ইটের তৈরি মন্দির ঐ উৎকর্ষের চরম সাক্ষ্য বহন করছে।

    শক্তিশালী গুপ্ত সম্রাটগণ বৈষ্ণবধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।





    ( তথ্য ঋণ ঃ ভারতীয় সভ্যতার রূপরেখা - চক্রবর্তী, কয়াল, হাজরা

    Tags

    Post a Comment

    0 Comments
    * Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

    Top Post Ad

    Below Post Ad